বর্তমানে মানুষ জীবিকার জন্য নানা ধরনের কাজ করছে।এগুলোর মধ্যে কোন কোন কাজ আবার শখ থেকে শুরু হয়েছে। পাখি পোষা সাধারণত মানুষ শখের বশেই করে থাকে।কিন্তু শখ যখন বাড়তি অর্থ আয়ের পথ দেখায় তখন সেটাকে পেশা হিসেবেও নেয়া যায়। যেমন কোয়েল পাখি পালন।ছোট পাখি কোয়েল পালন করেও আপনি নতুন ব্যবসা শুরু করতে পারেন।কারন এ পাখিটি পালন করতে তেমন খরচ হয় না এবং পরিচর্যাও কম লাগে।
আজকে জানব কোয়েল পাখির ব্যবসা শুরু করার নিয়ম নিয়ে।এ ব্যবসাটি করতে গেলে মুলধন কম লাগলেও কিছু নিয়মকানুন ও পরিচর্যা বিষয়ে জানতে হবে।কারন পাখিটির ছোট থেকে বড় হওয়া,খাদ্য,ডিম উৎপাদন, বাচ্চা
উৎপাদন,রোগের ওষুধ ইত্যাদি নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকলে ব্যবসায় লাভের আশা করা যাবে না।কোয়েল পাখি পালন বিষয়ে যথোপযুক্ত জ্ঞান বা প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কারন বর্তমানে বাজারে এ পাখিটির ডিম ও মাংসের অনেক চাহিদা রয়েছে।এ চাহিদা পুরনের জন্য এ পাখিটি ঘরোয়া পরিবেশে স্বল্প পরিসরে পালন করতে পারেন।এমনকি নারী বা অল্প বয়সি শিক্ষার্থীরাও এটি পালন করে উদ্যোক্তা ও স্বনির্ভর হতে পারে।
অন্য পোস্টঃকাপড়ের ব্যবসা শুরু করে একজন সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার উপায়
ব্যবসা শুরু করার আগে কোয়েলের পরিচিতি জেনে নিই
কোয়েল পাখিটির উৎপত্তি জাপানে।সর্বপ্রথম জাপানে বন্য এ পাখিটিকে বাড়িতে পোষ মানানো শুরু করা হয়।প্রথম দিকে মাংস খাওয়ার জন্য পালন করলেও পরবর্তীতে এটির ডিম খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়।ধীরে ধীরে জাপানের বাইরে পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতেও কোয়েল পালন পরিচিতি পেয়েছে।
একটি কোয়েল পাখি সাধারণত ৩ থেকে ৪ বছর বেঁচে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক একটি কোয়েলের ওজন ১৫০-২০০ গ্রাম এবং এর একটি ডিমের ওজন প্রায় ৭-১৫ গ্রাম হয়ে থাকে।মেয়ে কোয়েল পাখি ৬ থেকে ৭ সপ্তাহের মধ্যে ডিম দেয়া শুরু করে। তারা প্রথম বছর ৩০০ এর বেশি ডিম দিয়ে থাকে এবং পরবর্তী বছরে ডিমের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে।
কোয়েল পাখির ব্যবসা শুরু করার নিয়ম
কোয়েল পাখি পালন পোল্ট্রি শিল্পেরই একটি অংশ।পোল্ট্রি ব্যবসায় সবচেয়ে ছোট পাখি হল কোয়েল।কোয়েল পালন টার্কিশ মুরগী বা হাঁস পালন করার মতোই লাভজনক। প্রায় সব ধরণের আবহাওয়ায় কোয়েল পাখি পালন করা যায়।এগুলোর রোগ বালাই খুব কম হয় তাই খামারির আর্থিক ক্ষতিও হয় কম।
ব্যবসার জন্য কোয়েলের প্রজাতি নির্বাচনঃ
ব্যবসার জন্য সঠিক জাতের কোয়েল পাখি নির্বাচন করুন।বর্তমানে প্রায় ১৮ প্রজাতির কোয়েল পাওয়া যায়। যার প্রায় প্রতিটি জাত পালনই লাভজনক।কিছু প্রজাতি ডিম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত এবং কিছু মাংস উৎপাদনের জন্য।মুরগীর মত কোয়েলের দুটি প্রজাতি হল ব্রয়লার ও লেয়ার।
লেয়ার বা ডিম উৎপাদনকারী কোয়েলের জাতঃ
১.Tuxedo ( জাপানিজ কোয়েল )
২.Pharaoh (ফারাও)
৩.British Range (ব্রিটিশ রেঞ্জ)
৪.English White ( ইংরেজি হোয়াইট)
৫.Manchurian
ব্রয়লার বা মাংস উৎপাদনকারী কোয়েলের জাতঃ
১.Bobwhite (আমেরিকান কোয়েল)
২.White Breasted (ভারতীয় কোয়েল)
অন্য পোস্টঃসুপারির ব্যবসা শুরু করে লাখ টাকা ইনকাম করার উপায়
কোয়েল পালনের জন্য স্থান নির্বাচনঃ
কোয়েল পালনের জন্য স্থান নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।কোয়েল পাখি খাঁচা বা ঘর বানিয়ে পালন করতে হয়।পর্যাপ্ত আলো ও বাতাস চলাচল করে এমন জায়গায় খাঁচাটি রাখতে হবে।কোয়েল পাখি আকারে ছোট বিধায় অনেকে ঘরের বারান্দা, ব্যালকনি বা ছাদে পালন করে লাভবান হতে পারেন।আবার যাদের বেশি জায়গা আছে তার উঠান বা বাড়ির পাশের অতিরিক্ত খোলা জায়গায় খাঁচা বা ঘর বানিয়ে নিতে পারেন।
তবে খেয়াল রাখতে হবে কোয়েলের খাঁচা বা ঘরটি যেন অবশ্যই বন্য প্রাণীদের নাগালের বাইরে থাকে। এছাড়াও সব ধরনের শিকারী প্রাণি যেমন কুকুর, ইঁদুর ও বিড়ালের নাগালের বাইরে রাখতে হবে।
কোয়েল পালনে খাঁচা তৈরিঃ
খাঁচা ও লিটার এ দুই পদ্ধতিতে কোয়েল পালন করা গেলেও খাঁচা পদ্ধতিই বেশি সুবিধাজনক।কারন এ পদ্ধতিতে ব্যবস্থাপনা সহজ এবং রোগ বা অন্যান্য সমস্যা কম হয়ে থাকে।
আবদ্ধ অবস্থায় মাত্র ০.৯১ বর্গমিটার জায়গায় ৬ থেকে ৮ টি কোয়েল পালন করা যায়।লম্বায় ১২০ সেমি ও প্রস্থে ৬০ সেমি খাঁচার মধ্যে ৫০ টি কোয়েল পাখি একসাথে পালন করা যায়।কোয়েলের খাঁচা তৈরীর জন্য প্লাস্টিক বা লোহার তারের নেট ব্যবহার করুন।প্রাপ্তবয়স্ক কোয়েলের জন্য নেটের ছিদ্রের মাপ ৫ মিমি x ৫ মিমি হবে।তবে প্লাস্টিকের খাঁচা কোয়েল পালনের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক।
খাঁচার ভেতর আলোর ব্যবস্থাঃ
কোয়েল পাখির খাঁচা রাখার জায়গাটিতে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম দুধরনের পর্যাপ্ত আলো চলাচলের ও সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে।কারন কোয়েলের ডিম উৎপাদনে আলোর ভুমিকা অনেক।৬ সপ্তাহ বয়সী মেয়ে কোয়েলকে দিনের আলোসহ ১৩ ঘন্টা আলো সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।৭,৮,৯ সপ্তাহ বয়সে মেয়ে কোয়েলকে আলো সরবরাহের সময় পর্যায়ক্রমে বাড়াতে হবে। আর সাদা আলোর চেয়ে লাল আলোয় কোয়েল পাখির ডিম উৎপাদন বাড়ে তাই খামারে বা খাঁচার মধ্যে এনার্জি বাল্বের পরিবর্তে ৪০ ওয়াটের হলুদ বাল্ব জ্বালিয়ে রাখলে ভালো হয়।
কোয়েলকে খাদ্য হিসেবে কি খাওয়াবেনঃ
স্বাস্থ্যবান,ক্রমবর্ধমান ও অত্যন্ত উৎপাদনশীল রাখতে কোয়েল পাখিকে নিয়মিত ভাবে সুষম ফিড প্রদান করতে হবে। কোয়েল পাখির জন্য যদিও বাজারে নির্দিষ্ট কোন ফিড নেই।তাই মুরগীর জন্য তৈরি ফিডকেই কোয়েল পাখিকে খাওয়ানো হয়।এছাড়া ঘরে থাকা গমভাঙা,খুদ ইত্যাদিও খাবার হিসেবে দেওয়া যায়।তবে বাজারে পাওয়া রেডিমেড ফিডে সব খাদ্য উপাদান সুষম পরিমানে থাকে।কোয়েল পাখিকে খাওয়ানোর জন্য এদের খাদ্যকে সাধারণত স্টার্টার,গ্রোয়ার ও লেয়ার এ তিন ভাগে ভাগ করা হয়।
একটি প্রাপ্তবয়স্ক কোয়েল পাখি প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ গ্রাম খাবার খায়।বাচ্চা কোয়েলের খাদ্যে ২৭% এবং প্রাপ্তবয়স্ক কোয়েলের খাদ্যে ২২-২৪% প্রোটিন থাকতে হয়। একটি পুর্নবয়স্ক কোয়েল পাখির বছরে মাত্র ৮ কেজি খাদ্যের প্রয়োজন হয়।
কোয়েলের সুস্থতার জন্য তৈরি খাবারের পাশাপাশি পানি গ্রহন কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি সুস্থ কোয়েল শুকনা খাবারের দ্বিগুন পানি পান করে।দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য পরিপাক,রক্তে পুষ্টি উপাদান ও রাসায়নিক দ্রব্য পরিবহন ঘটতে পানি গ্রহন করা জরুরি।
আর অবশ্যই বিশুদ্ধ পানি পান করতে দিতে হবে।ডীপ টিউবওয়েল বা বৃষ্টির পানি বা ফিটকিরি দিয়ে পরিস্কার করা পানি দিনে অন্তত দুইবার সরবরাহ করতে হবে।তাছাড়া পানির পাত্রটি পুরোপুরি পুর্ন করা যাবে না। এতে পানি পড়ে গিয়ে খাঁচার মেঝে ভিজে গিয়ে স্যাঁতসেতে হয়ে যায়।
কোয়েলের খাদ্য সংরক্ষণঃ
বানিজ্যিকাভাবে কোয়েল পালন শুরু করলে একসাথে অনেক খাদ্য কিনতে হয়।এই খাদ্য যদি নষ্ট হয়ে যায় তবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।কারন নষ্ট খাদ্য খেলে পাখির জীবনও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
একসাথে অনেক খাদ্য বা ফিড কিনলেও ৮ সপ্তাহের বেশি সময় সংরক্ষণ করা উচিত নয়।কারন এর বেশি সময় পার হলে খাদ্যের ভিটামিন ও অন্যান্য গুনাগুন নষ্ট হয়ে যায় এমনকি পঁচে যেতে পারে।খাদ্য বস্তায় রাখলে এর মুখ ভালো করে আটকে রাখুন আর টিন জাত কৌটা বা প্লাস্টিক কন্টেইনারে রাখলে মুখ বা ঢাকনা ভালো করে লাগিয়ে রাখতে হবে যাতে বাতাস না ঢুকতে পারে।কারন বাতাস ঢুকলে খাদ্যে ছত্রাক আক্রমন করবে।এছাড়া খাদ্য কেনার সময় অবশ্যই মেয়াদ দেখে কিনবেন।
অন্য পোস্টঃবর্তমান সময়ের সেরা কয়েকটি লস ছাড়া ব্যবসা আইডিয়া
কোয়েলের খাবার ও পানি গ্রহনের পাত্রঃ
কোয়েল পাখির ব্যবসা শুরু করার নিয়ম জানার মধ্যে খাবার ও পানির পাত্রের বিষয়ে জ্ঞান রাখাও অন্তর্ভুক্ত।
খাবার পাত্রঃ ১ সপ্তাহ বয়সী কোয়েল পাখিকে পেপারে ছিটিয়ে খাবার দেওয়া হয়।২ সপ্তাহ বয়সী ১৫০টি কোয়েল পাখির জন্য ১ টি পাত্র ,৩ সপ্তাহ বয়সী ১২০টি কোয়েল পাখির জন্য ১ টি পাত্র,৪ সপ্তাহ বয়সী ১১০টি কোয়েল পাখির জন্য ১ টি পাত্র,৫ সপ্তাহ ও তার বেশি বয়সী ১০০ টি কোয়েলের জন্য ১ টি পাত্র দরকার হবে।
পানির পাত্রঃ ১ সপ্তাহ বয়সী ১৫০ টি কোয়েল পাখিকে পানি বরাদ্দের জন্য বোতলযুক্ত ছোট ১ টি পাত্র, ২ সপ্তাহ বয়সী ১৪০টি কোয়েল পাখির জন্য ১ টি মাঝারী পানির পাত্র ,৩ সপ্তাহ বয়সী ১২০টি কোয়েল পাখির জন্য মাঝারী পানির পাত্র ১ টি,৪ সপ্তাহ বয়সী ১১০টি কোয়েল পাখির জন্য বড় ১ টি পানির পাত্র,৫ সপ্তাহ ও তার বেশি বয়সী ১০০ টি কোয়েলের জন্য বড় ১ টি পানির পাত্রের দরকার হবে।
গরম ও শীতে কোয়েলের যত্নঃ
ঋতুভেদে কোয়েল পাখিকেও একটু বিশেষ যত্নে রাখতে হয়।গ্রীষ্মকালে বা বছরের অন্যান্য সময়ে তীব্র গরম পড়লে খামারে বা পাখির খাঁচাটিতে পর্যাপ্ত ঠান্ডা বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা রাখতে হবে।বৈদ্যুতিক ফ্যান লাগাতে হবে যা প্রয়োজনে বাতাসের পরিমাণ কমানো বা বাড়ানো যাবে।আর ঠান্ডা পানি পাখির গায়ে স্প্রে করে ছিটানো যায়।অতিরিক্ত গরমে পানির সাথে গ্লুকোজ,স্যালাইন,ভিটামিন সি সেবন করানো যেতে পারে।
আর শীতকালে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করতে বাল্ব ও ইন্ফ্রার্রড হিটার লাগাতে হয়। এছাড়া কুয়াশা ও ঠান্ডা বাতাস আসা বন্ধ করতে খাঁচার চারপাশে পর্দা লাগিয়ে রাখা যায়।পাখির ঠান্ডা লেগে গেলে ওষুধ সেবন করাতে হবে।
পরিশেষে কোয়েল পাখির ব্যবসা শুরু করার নিয়ম জেনে আপনারাও শুরু করতে পারেন এই ব্যবসা।কারন অল্প পুঁজিতে,অল্প শ্রমে বেশি লাভ ও সেই সাথে শখ পুরনের এমন ব্যবসা কমই রয়েছে।তাছাড়া কোয়েল পাখির ডিম ও মাংস খেতে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর যা আপনার পরিবারের সবার আমিষের চাহিদা মেটাতে সাহায্য করে।