ডায়াবেটিস কি? ডায়াবেটিস কেন হয়? ডায়াবেটিস নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

103 0
ডায়াবেটিস কি? ডায়াবেটিস কেন হয়? ডায়াবেটিস নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

ডায়াবেটিস কি ?
ডায়াবেটিস একটি বিপাক জনিত রোগ। আমাদের শরীরে ইনসুলিন নামের হরমোনের সম্পূর্ণ বা আপেক্ষিক ঘাটতির কারনে বিপাকজনিত গোলযোগ সৃষ্টি হয়ে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং এক সময় তা প্রস্রাবের সংগে বেরিয়ে আসে। এই সামগ্রিক অবস্থাকে ডায়াবেটিস বলে। ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক কোন রোগ নয়।

 লক্ষন ও উপসর্গঃ

  • ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
  • খুব বেশী পিপাসা লাগা
  • বেশী ক্ষুধা পাওয়া
  • যথেষ্ঠ খাওয়া সত্ত্বেও ওজন কমে যাওয়া
  • ক্লান্তি ও দুর্বলতা বোধ করা
  • ক্ষত শুকাতে দেরী হওয়া
  • খোশ-পাঁচড়া,ফোঁড়া প্রভৃতি চর্মরোগ দেখা দেওয়া
  • চোখে কম দেখা

ডায়াবেটিসের প্রকারভেদঃ

ডায়াবেটিসের মূলত চারটি ধরন রয়েছে।
ধরন-১ এই ধরনের রোগীদের শরীরে ইনসুলিন একেবারেই তৈরী হয় না। সাধারণতঃ ৩০ বৎসরের কম বয়সে (গড় বয়স ১০-২০ বৎসর) এ ধরনের ডায়াবেটিস দেখা যায়। সু্‌স্থ্য থাকার জন্য এ ধরনের রোগীকে ইনসুলিন নিতে হয়। এই ধরনের রোগীরা সাধারনত কৃষকায় হয়ে থাকেন।
ধরন-২ এই শ্রেণীর রোগীর বয়স অধিকাংশ ক্ষেত্রে ত্রিশ বৎসরের উপরে হয়ে থাকে। তবে ত্রিশ বৎসরের নিচে এই ধরনের রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এই ধরনের রোগীদের শরীরে ইনসুলিন তৈরী হয় তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ঠ নয় অথবা শরীরে ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমে যায়। অনেক সময় এই দুই ধরনের কারণ একই সাথে দেখা দিতে পারে। এই ধরনের রোগীরা ইনসুলিন নির্ভরশীল নন। অনেক ক্ষেত্রে খাদ্যাভাসের পরিবর্তন এবং নিয়িমিত ব্যয়ামের সাহায্যে এদের চিকিৎসা করা সম্ভব। এই ধরনের রোগীরা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে স্থূলকায় হয়ে থাকেন।

ধরন-৩ অন্যান্য নির্দিষ্ট কারণ ভিত্তিক শ্রেণী –

  • জেনেটিক কারনে ইনসুলিন তৈরী কম হওয়া
  • জেনেটিক কারনে ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া
  • অগ্ন্যাশয়ের বিভিন্ন রোগ
  • অন্যান্য হরমোনের আধিক্য
  • ঔষধ ও রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শ
  • সংক্রামক ব্যধি
  • অন্যান্য কোন প্রতিরোধ ক্ষমতার জটিলতা
    এই ধরনের রোগী ক্ষীণকায় ও অপুষ্টির শিকার হয়ে থাকে এবং ইনসুলিন ছাড়া অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারে। এই ধরনের রোগীর বয়স ৩০ বৎসরের নিচে হয়ে থাকে।

ধরন-৪ গর্ভকালীন ডায়াবেটিস –
অনেক সময় গর্ভবতী অবস্থায় প্রসূতিদের ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। আবার প্রসবের পর ডায়াবেটিস থাকে না। এই প্রকারের জটিলতাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলা হয়। গর্ভবতী মহিলাদের ডায়াবেটিস হলে গর্ভবতী, ভ্রুণ, প্রসূতি ও সদ্য-প্রসূত শিশু সকলের জন্যই বিপদজনক হতে পারে। বিপদ এড়ানোর জন্য গর্ভকালীন অবস্থায় ডায়াবেটিসের প্রয়োজনে ইনসুলিনের মাধ্যমে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার। এই ধরনের রোগীদের প্রসব হাসপাতালে করা প্রয়োজন।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে করণীয়ঃ

  • নিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ -ডায়াবেটিস হলে খাদ্যের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হয়। খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা ডায়াবেটিস হওয়ার আগে যে রকম থাকে পরেও একই থাকে। পুষ্টির চাহিদার কোন তারতম্য হয় না। খাদ্যের নিয়ম মেনে চলার প্রধান উদ্দেশ্য থাকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা ।
  • ব্যায়াম – রোগ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ব্যায়াম বা শরীর চর্চার ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ব্যায়াম করলে শরীর সু্‌স্থ থাকে,ইনসুলিনের কার্যকারিতা ও নিঃসরণের পরিমাণ বেড়ে যায়। প্রতিদিন অন্তত: ৪৫ মিনিট হাঁটলে শরীর যথেষ্ঠ সু্‌স্থ থাকবে। শারীরিক অসুবিধা থাকলে সাধ্যমত কায়িক পরিশ্রম করতে হবে।
  • ঔষধ – সকল ডায়াবেটিক রোগীকেই খাদ্য, ব্যায়াম ও শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে,বিশেষ করে বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে, এই দুইটি যথাযথভাবে পালন করতে পারলে রোগ নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে ইনসুলিন ইনজেকশনের দরকার হয়। টাইপ-২ ডায়বেটিস রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসক শর্করা কমাবার জন্য খাবার বড়ি দিতে পারেন।
  • শিক্ষা – ডায়াবেটিস আজীবনের রোগ। সঠিক ব্যবস্থা নিলে এই রোগকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ব্যবস্থাগুলি রোগীকেই নিজ দায়িত্বে মেনে চলতে হবে এবং রোগীর পরিবারের নিকট সদস্যদের সহযোগিতা এ ব্যাপারে অনেক সাহায্য করতে পারে। তাই এ রোগের সুচিকিৎসার জন্য ডায়াবেটিস সর্ম্পকে রোগীর যেমন শিক্ষা প্রয়োজন, তেমনি রোগীর নিকট আত্মীয়দেরও এই রোগ সর্ম্পকে কিছু জ্ঞান থাকা দরকার।

পথ্য ও বাড়তি সতর্কতাঃ

  • আঁশবহুল খাবার (ডাল,শাক,সবজি,টক ফল ইত্যাদি) বেশী খেতে হবে
  • উদ্ভিদ তেল, অর্থাৎ সয়াবিন তেল, সরিষার তেল ইত্যাদি এবং সব ধরনের মাছ খাওয়া অভ্যাস করতে হবে
  • ওজন স্বাভাবিক রাখতে হবে
  • চিনি-মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া বাদ দিতে হবে
  • চাল, আটা দিয়ে তৈরী খাবার,মিষ্টি ফল ইত্যাদি কিছুটা হিসেব করে খেতে হবে
  • ঘি, মাখন, চর্বি, ডালডা, মাংস ইত্যাদি কম খেতে হবে
  • অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হলে অর্থাৎ অসু্‌স্থ অবস্থায় বিশেষ খাদ্য-ব্যবস্থা জেনে নিতে হবে

যা মনে রাখতে হবেঃ

  • নিয়মিত ও পরিমাণ মতো সুষম খাবার খেতে হবে
  • নিয়মিত ও পরিমাণমতো ব্যায়াম বা দৈহিত পরিশ্রম করতে হবে
  • ডাক্তারের পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র সুষ্ঠভাবে মেনে চলতে হবে
  • শরীর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে
  • পায়ের বিশেষ যত্ন নিতে হবে
  • নিয়মিত প্রস্রাব পরীক্ষা করতে হবে এবং ফলাফল প্রস্রাব পরীক্ষার বইতে লিখে রাখতে হবে
  • চিনি, মিষ্টি, গুড়, মধুযুক্ত খাবার সম্পূর্ণ বাদ দিতে হবে
  • ধূমপান করা যাবে না
  • শারীরিক কোন অসুবিধা দেখা দিলে দেরী না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে
  • ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন কারণেই ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা বন্ধ রাখা যাবে না।

ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে সফট্ ড্রিংকস

সফট ড্রিংকস্ খুব মজার একটি পানীয়।এটি খেতে যেমন মজাদার ঠিক ততটাই ক্ষতিকর। সফট ড্রিংকস্ বাড়িয়ে দিতে পারে আপনার হৃদরোগ বা ডায়াবেটিস। তাই সফট ড্রিংকস্ খাওয়ার ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। এব্যাপারে গবেষকরা বলেছেন, দৈনিক এক বা একাধিক ক্যান সফট্ ড্রিংকস্ অর্থাৎ মিষ্টি হালকা পানীয় পান শেষ বয়সে একজন লোকের ডায়াবেটিস রোগ হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

ইওরোপীয় বিজ্ঞানীরা বলেছেন, দিনে এক ক্যান সফট্ ড্রিংকস্ পান টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি মাসে এক ক্যান ড্রিংকস পানের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশী ঝুঁকি সৃষ্টি করে। পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণালব্ধ এই তথ্যটি ‘ডায়াবেটোলজিয়া’ নামক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। একটি ডায়াবেটিস চ্যারিটি সুগারপূর্ণ খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ সীমিতকরণের সুপারিশ করেছে- কারণ এগুলোতে ক্যালোরি বেশী এবং এগুলো ওজন বৃদ্ধি করে।

সম্প্রতি যুক্তরাজ্য জার্মানী, ডেনমার্ক, ইতালী, স্পেন, সুইডেন, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডে গবেষণা চালানো হয়। এতে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ লোককে তাদের খাবারের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়। খাবর ও ক্যান্সারের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয়ের লক্ষ্যে একটি ব্যাপক ভিত্তিক ইওরোপীয় সমীক্ষার অংশ হিসেবে এটা করা হয়। লন্ডনের ইমপিরিয়েল কলেজ-এর গবেষক ডোরা রোমা-গুয়েরা বলেন, চিনিমিশ্রিত হালকা পানীয় আপনার ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে-তাই হালকা পানীয়র প্রতিটি ক্যান, যা আপনি প্রতিদিন পান করেন, এতে ঝুঁকি বাড়ে।’ তিনি মিষ্টি হালকা পানীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট গণস্বাস্থ্য তথ্যের আহবান জানান।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন-এর অধ্যাপক প্যাট্রিক উলফে বলেন, মিষ্টি কোমল পানীয় টাইপ-২ ডায়াবেটিসের একটি অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান। ড: রমাগুয়েরা ও তার সহ-গবেষকরা এই বলে তাদের গবেষণা পত্রের উপসংহার টেনেছেন, যেহেতু ইওরোপে মিষ্টি পানীয় গ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই স্বাস্থ্যের উপর এর ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি জনগণকে জানানো দরকার।’
গবেষকদের মতে, ফলের রস পান ডায়াবেটিসের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত নয়। যুক্তরাজ্যে ডায়াবেটিস গবেষণার প্রধান ড: ম্যাথু হবস বলেন, দেহের ওজন কম বেশী নির্বিশেষে মিষ্টি কোমল পানীয়র সাথে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। এতে প্রতীয়মান বর্ধিত ঝুঁকি শুধুমাত্র অতিরিক্ত ক্যালোরির কারণেই নয়। পরিসংখ্যান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক প্যাট্রিক উলফে বলেন, যুক্তরাজ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বয়স্ক জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ৪ ভাগ। আর যেহেতু মিষ্টি কোমল পানীয় খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিয়ে এটা দূর করা সম্ভব, তাই এটা করাই উত্তম।

Leave a Reply