থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে জেনে রাখুন

120 0
থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে জেনে রাখুন

থ্যালাসেমিয়া (ইংরেজি: Thalassemia) একটি বংশগত রক্তের রোগ। এই রোগে রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিন কণার উৎপাদনে ত্রুটি হয়। থ্যালাসেমিয়া রোগ ধারণকারী মানুষ সাধারণত রক্তে অক্সিজেনস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়াতে ভুগে থাকেন। অ্যানিমিয়ার ফলে অবসাদগ্রস্ততা থেকে শুরু করে অঙ্গহানি ঘটতে পারে। থ্যালাসেমিয়া রোগ দুইটি প্রধান ধরনের হতে পারে: আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বেটা থ্যালাসেমিয়া। সাধারণভাবে আলফা থ্যালাসেমিয়া বেটা থ্যালাসেমিয়া থেকে কম তীব্র। আলফা থ্যালাসেমিয়াবিশিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে রোগের উপসর্গ মৃদু বা মাঝারি প্রকৃতির হয়। অন্যদিকে বেটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা বা প্রকোপ অনেক বেশি; এক-দুই বছরের শিশুর ক্ষেত্রে ঠিকমত চিকিৎসা না করলে এটি শিশুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

বিশ্বে বেটা থ্যালাসেমিয়ার চেয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। আলফা থ্যালাসেমিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সর্বত্র এবং কখনও কখনও ভূমধ্যসাগরীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের লোকদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১ লক্ষ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।

লক্ষণ সমুহঃ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর কিছু লক্ষন দেখা দেয়। যেমন অতিরিক্ত আয়রন, সংক্রমণ, অস্বাভাবিক অস্থি, প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, অবসাদ অনুভব, দূর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, মুখ-মন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, অস্বস্তি, ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস), মুখের হাড়ের বিকৃতি, ধীরগতিতে শারীরিক বৃদ্ধি, পেট বাইরের দিকে প্রসারিত হওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া, গাঢ় রঙের প্রস্রাব, হৃৎপিণ্ডে সমস্যা ইত্যাদি।

কারণঃ ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জিনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। বাবা অথবা মা, অথবা বাবা- মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া জীন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়।এক সমীক্ষায় দেখা যায়,বাবা এবং মা উভয়ের থ্যালাসেমিয়া জীন থাকলে ভূমিষ্ট শিশুর শতকরা ২৫ ভাগ থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়।

থ্যালাসেমিয়া দুইটি প্রধান ধরনের হতে পারে: আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বিটা থ্যালাসেমিয়া।

আলফা থ্যালাসেমিয়া :এই রোগের জন্য 16 নং ক্রোমোজোমে উপস্থিত আলফা-শৃঙ্খল উৎপাদনকারী জিনের mutation বা deletion দায়ী।চারটি জিন দিয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়া শিকল তৈরি হয়। বাবা-মা থেকে প্রাপ্ত চারটি জিনের মধ্যে এক বা তার অধিক ত্রুটিপূর্ণ হলে আলফা থ্যালাসেমিয়া হয়। যত বেশি জিন ত্রুটিপূর্ণ হবে তত বেশি মারাত্মক সমস্যা দেখা দিবে।যেমন :

    • একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে থ্যালাসেমিয়ার কোন লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যাবে না। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তার সন্তানের মধ্যে এই রোগ ছড়াবে।
    • দুইটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যাবে। এই অবস্থাকে বলে আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (Alpha-thalassemia minor) অথবা আলফা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট ( Alpha-thalassemia trait).
    • তিনটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে এর উপসর্গগুলো মাঝারি থেকে মারাত্মক আকার ধারণ করে। এই অবস্থাকে বলে হিমোগ্লোবিন এইচ ডিজিজ (Hemoglobin H Disease)।
    • চারটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে একে বলে আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর (Alpha thalassemia major) অথবা হাইড্রপস ফিটালিস (Hydrops fetalis)। এর ফলে প্রসবের (delivery) পূর্বে অথবা জিনের পরপর ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায়।

বিটা থ্যালাসেমিয়া: বিটা থ্যালাসেমিয়া শিকল গঠিত (Chain) হয় দুইটি জিন দিয়ে। বাবা-মা থেকে প্রাপ্ত চারটি জিনের মধ্যে এক বা তার অধিক ত্রুটিপূর্ণ হলে বিটা থ্যালাসেমিয়া হয় এক্ষেত্রে :

    • একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যায়। এই অবস্থাকে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (Beta-thalassemia minor) অথবা বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট (Beta-thalassemia trait).
    • দুটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে মাঝারি থেকে মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায়। এ অবস্থাকে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর ( Beta-thalassemia major) অথবা কুলিস অ্যানিমিয়া (Cooley’s anemia)। নবজাতক যেসব শিশুর এই সমস্যা থাকে তারা জন্মের সময় বেশ স্বাস্থ্যবান থাকে। তবে জন্মের প্রথম দুই বছরের মধ্যেই এর উপসর্গ দেখা যায়।

বিশ্বের আনুমানিক ৬০-৮০ মিলিওন মানুষ বিটা থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করছে।থ্যালাসেমিয়া স্বল্প উন্নত দেশ যেমন নেপাল,বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে বেশি দেখা যায়।আশঙ্কা করা হচ্ছে,আগামী ৫০ বছরে থ্যালাসেমিয়া অনেক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।

থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা

মাইনর থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত চিকিৎসার কোন প্রয়োজন হয় না। অপরদিকে মেজর থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে, নিয়মিত রক্ত গ্রহন (প্রয়োজনবোধে বছরে ৮ থেকে ১০ বার) করতে হয়। বার বার রক্ত নেওয়ার ফলে বিভিন্ন অঙ্গে অতিরিক্ত লৌহ জমে যেতে পারে এবং এর ফলে যকৃত বিকল হয়ে যেতে পারে। তাই, এরকম ক্ষেত্রে জটিলতা এড়াতে আয়রন চিলেশন থেরাপীর সাহায্যে অতিরিক্ত লৌহ বের করে দেওয়া হয়।

অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগ হতে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে একজন ম্যাচ ডোনার লাগবে। আমাদের দেশে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা না থাকায়, এই অপারেশন দেশের বাইরে গিয়ে করতে হয়। এছাড়াও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রণ এবং ফলিক এসিড সেবন করতে হতে পারে। আবার জীবনযাপন পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন- চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিত কোন ঔষধ বা ভিটামিন সেবন না করা, সুষম ও পুষ্টিকর খাবার বিশেষ করে ক্যালসিয়াম, জিংক, ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে ইত্যাদি।

থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধে করনীয়

  • পরিবারের কারও থ্যালাসেমিয়া রোগের ইতিহাস থাকলে, সন্তান গ্রহনের পূর্বে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
  • বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র এবং পাত্রীর রক্ত পরীক্ষা করে দেখতে হবে, তাদের মধ্যে কেউ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত কিনা। আবার নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়া রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই, এ ব্যপারে সাবধান হতে হবে।

শিশুর থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়

থ্যালাসেমিয়া মেজর অর্থাৎ যে শিশু বাবা এবং মা উভয়ের কাছ থেকেই সমস্যাগ্রস্ত জিন জন্মগতভাবে পেয়েছে, জন্মের পরপরই শিশুটিকে ফ্যাকাসে দেখা যাবে। শিশুর বৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবে হবে না অর্থাৎ তার হাঁটা, দাঁড়ানো বা বসা সবকিছুই অন্য বাচ্চাদের তুলনায় অনেক ধীরে হবে। ১০ বছরের একটা স্বাভাবিক বাচ্চার তুলনায় একটা অসুস্থ্য বাচ্চা দেখতে ৫ বছরের মত লাগবে। শিশুটির রক্তস্বল্পতা, ক্ষুধামন্দা, সব বিষয়ে অনাগ্রহ ইত্যাদি দেখা যাবে। আবার দুই চোখের দূরত্বটা বেড়ে যেতে পারে, নাকের গোড়া প্রসারিত হয়ে যেতে পারে, কপালের সামনের হাড় ফুলে উঠতে পারে, দাঁত ফাঁক হয়ে যেতে পারে, পেট ফুলে উঠতে পারে, হাত পা ও চোখ হলুদ দেখা যেতে পারে ইত্যাদি অর্থাৎ শিশুটিকে দেখে স্বাভাবিক মনে হবে না। আবার পরীক্ষা করলে তার প্লিহা দেখা যাবে। এই প্লিহা প্রথমে বড় হয়, এর পর আস্তে আস্তে লিভার বড় হয়। এই অঙ্গগুলো বড় হলে, তখন খুব ঘন ঘন রক্ত দিতে হয়। নিয়মিত রক্ত না দিলে শিশুটি স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারে না।

বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা কতটা জরুরি

থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধের পূর্ব সতর্কতাস্বরূপ বিয়ের আগে পাত্র এবং পাত্রীর রক্তের হিমোগ্লোবিনের অবস্থা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। স্বামী এবং স্ত্রী দু’জনেই এ রোগের বাহক হলে সন্তানের এ রোগ হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। সাধারনত থ্যালাসেমিয়ার কোনোরূপ সম্ভাবনা আছে এমন পুরুষ বা মহিলার সঙ্গে অন্য কোন থ্যালাসেমিয়া রোগী বা রোগের সম্ভাবনা আছে এমন কারও বিয়ে হলে তাদের সন্তানের এই রোগে আক্রান্তের সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং বিয়ের পূর্বে রক্ত পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিলে সেটা সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

থ্যালাসেমিয়া রোগ একটি জিনঘটিত রোগ। এই রোগে রক্তের লোহিতকণিকা ভেঙে যায় এবং রোগী রক্তস্বল্পতায় ভুগতে থাকে। রক্তের সম্পর্কের মধ্য বিয়ে হলে, তাদের সন্তানদের মধ্যে এই রোগটি বেশি হতে পারে। তাই, থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। তাই, বিয়ের পূর্বে রক্ত পরীক্ষা এবং নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে পরিত্যাগের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করতে হবে।

Leave a Reply