“প্রেগনেন্সি” কথাটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। একটি দেহের মাঝে আরেকটি প্রানের অস্তিত্ব। মেয়েদের প্রেগনেন্সির সময় অনেকের নানা রকম সাধারণ কিছু সমস্যা দেখা দেয়। সেগুলোতে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। মায়ের স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভর করে সন্তানের বাঁচা-মরা। প্রেগনেন্সিতে স্বাভাবিক অবস্থা থেকে হরমোনের বেশ তারতম্য ঘটে, শারীরিক গঠনের কিছু পরিবর্তন হয়, তাই মায়ের কিছু কিছু শারীরিক সমস্যা নতুন করে দেখা দেয় বা বেড়ে যায়। দেখা যায় যে, ডেলিভারি হয়ে যাবার পরপর সে সমস্যাগুলোও চলে যায়। এগুলোর বেশিরভাগই ফিজিওলজিক্যাল বা স্বাভাবিক। প্রেগনেন্সি ইস্যুটা যেহেতু সবার কাছে খুব সেন্সিটিভ তাই অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এসব সমস্যায়। আসলে খুব বেশি আতঙ্কগ্রস্ত হবার কিছু নেই। জীবনধারায় কিছু পরিবর্তন নিয়ে এলে, কিছু পরামর্শ মেনে চললে যার অধিকাংশই প্রতিকার বা প্রতিরোধ করা যায়। একেবারেই কমন কিছু সমস্যার সমাধান নিয়ে লেখার চেষ্টা করছি। বিষয়গুলো সবারই জানা থাকা প্রয়োজন।
কোমর ব্যথাঃ প্রতি ১০০ জনের প্রায় ৫০ জনেরই এ সমস্যা দেখা দেয়।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে, মোট দশ ঘণ্টা।
- অনেক বেশি ওজন বাড়িয়ে ফেলা পরিহার করতে হবে।
- পা কিছুটা উঁচুতে রেখে যেমনঃ পায়ের নিচে একটা বা দুটো বালিশ রেখে বিশ্রাম নিন।
- শক্ত বিছানায় শোয়া ভালো।
- দাঁড়ানোর সময় সোজা হয়ে দাঁড়াবেন।
- উঁচু হিলযুক্ত জুতো পরা যাবে না।
- কুঁজো হয়ে বসা বা কোনো জিনিস নিচ থেকে তোলা পরিহার করা শ্রেয়।
- ভারী এবং পরিশ্রমের কাজ করবেন না।
- কোমরে ম্যাসাজ করতে পারেন।
- গরম বা ঠাণ্ডা কিছু দিয়ে স্যাঁক দিতে পারেন।
বমিবমি ভাব এবং বমিঃ প্রেগনেন্সির অন্যতম সমস্যা হল বমিবমি ভাব এবং বমি করা। দেখা যায় যে প্রতি ১০০ জন গর্ভবতীর প্রায় ৭৫ জনেরই এ সমস্যাটা দেখা দেয়। সাধারণত সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরপরই এ সমস্যা হয়।
- সকালে ঘুম থেকে উঠেই, বলা হয়ে থাকে বিছানাতেই শুকনো খাবার যেমন : টোস্ট, বিস্কিট, মুড়ি ইত্যাদি খেতে।
- প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার বেশি খেতে বলা হয়।
- অতিরিক্ত তেল-চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করতে হয়।
- একবারে বেশি খাবার না খেয়ে অল্প অল্প করে বারবার খান।
কোষ্ঠকাঠিন্যঃ
- প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে।
- আঁশজাতীয় খাবার যেমন : শাকসবজি এবং তাজা ফলমূল বেশি করে খেতে হবে।
- ইসপগুলের ভূষি খাওয়া যেতে পারে।
- চাপ এলে টয়লেটে যেতে বিলম্ব করা যাবে না।
- কিছুটা হাঁটাচলার অভ্যেস করা ভালো, দিনে ২০-৩০ মিনিট করে সপ্তাহে ৩ দিন হাঁটা যেতে পারে।
পায়ে পানি আসা ও পা ফোলাঃ
- বিশ্রাম নিন এবং পা দুটো একটা বা দুটো বালিশের ওপর রাখুন।
- একটানা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকবেন না।
- আরামদায়ক জুতো পরুন।
- বেশি করে পানি পান করুন।
পায়ে খিল ধরাঃ
- পায়ে ম্যাসাজ করতে হবে।
- গরম স্যাঁক দিলে উপকার পাওয়া যায়।
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন বি-ওয়ান সেবন করতে হয়।
বুক জ্বালাপোড়া ও এসিডিটিঃ
- একসাথে অনেক বেশি খাবার খেয়ে ফেলা পরিহার করতে হবে।
- খাবার পরপরই বিছানায় শুতে চলে যাওয়া যাবে না।
- বিছানায় যাবার অনেকক্ষণ আগেই খাবার খেয়ে ফেলুন।
- উঁচু বালিশে শুলে আরাম পাওয়া যায়।
- এন্টাসিড জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।
মাসিকের রাস্তায় সাদা স্রাবঃ
- ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এর প্রধান চিকিৎসা।
- নরম সূতি আন্ডারগার্মেন্টস ব্যবহার করা ভালো।
পায়ে আঁকাবাঁকা শিরা, পাইলসঃ
- পায়ে আঁকাবাঁকা শিরার জন্যে ক্রেপ ব্যাণ্ডেজ ব্যবহার এবং বিশ্রামের সময় পা উঁচু করে রাখতে বলা হয়।
- পাইলসের জন্যে নিয়মিত টয়লেট সারা জরুরি; কোষ্ঠকাঠিন্য যেন না হয়ে যায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। টয়লেট সারার সময় বেশি চাপ দেওয়া যাবে না। বাম কাত হয়ে শোয়া ভালো।
- গরম পানি দিয়ে গোসল করতে পারেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।
গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপঃ
যে কোন নারী গর্ভাবস্থায় ভুগতে পারেন উচ্চ রক্ত চাপে। হতে পারে কেউ কেউ গর্ভধারণের আগেই উচ্চরক্ত চাপের সমস্যায় ভুগছিলেন আবার এমনও হতে পারে গর্ভধারণের পরে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যাটি ধরা পড়েছে। আসুন কিছু জেনে নেওয়া যাক উচ্চ রক্ত চাপ সম্পর্কে
বুঝবেন কিভাবে
- রক্তচাপ ১৪০/৯০ মি.মি. বা তার বেশি হবে, ২ বা তার বেশিবার মাপার পর মাথাব্যথা, ঘাড়ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, পা বা পুরো শরীর ফুলে যাওয়া, ওপরের পেটে ব্যথা, বাচ্চার নড়াচড়া কমে যেতে পারে।
কি করনীয়
- গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে নিয়মিত রক্তচাপ মাপতে হবে কিছু বিশেষ পরীক্ষা—হিমোগ্লোবিন, প্ল্যাটিলেট, ইউরিক অ্যাসিড, বিলিরুবিন, আলট্রাসনোগ্রাফি ইত্যাদি করতে হবে প্রস্রাবে আমিষ যাচ্ছে কি না, সেটাও দেখা জরুরী।
কি কি জটিলতা দেখা দিতে পারে
- গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ না হলে রোগীর প্রি একলেম্পশিয়া হতে পারে, এমনকি খিঁচুনিও হতে পারে।
- ফুসফুসে পানি জমা বা হার্ট ফেইলিওর,
- কিডনি বা লিভারের অকার্যকারিতা,
- মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে।
পরামর্শ
- সব ওষুধ গর্ভকালের জন্য নয়। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ নিয়ম অনুযায়ী খেতে হবে
- জটিলতা দেখা দিলে হাসপাতালে ভর্তি হোন
- যদি গর্ভস্থ শিশু পরিপক্ব হওয়ার আগেই জরুরি ডেলিভারি প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে মা ও শিশুর কিছু পূর্বপ্রস্তুতির ব্যবস্থা নিতে হয় মা ও শিশুর অবস্থা বিবেচনা করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডেলিভারি কখন, কোথায়, কীভাবে হবে, তা আগে থেকেই নির্ধারণ করতে হবে।
তবে মনে রাখতে হবে যে, ছোট ছোট সমস্যা গুলো যেন বড় হতে না পারে সে দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। যদি সেই সমস্যা বেশি মনে হয় তাহলে অতিসত্বর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যান। মায়ের পেটের মধ্যে থাকা ছোট্ট বাবুটি আগামি দিনের ভবিষ্যৎ। তাকে নিয়েই সব স্বপ্ন ও ভাবনা। সেই স্বপ্নগুলো যেন কোন ভাবেই ধূলিসাৎ না হয়। কারণ ছোট ছোট সমস্যাগুলো হতে পারে আপনার স্বপ্ন ভঙ্গের কারণ।