হাঁপানি প্রতিরোধের উপায়

95 0
হাঁপানি প্রতিরোধের উপায়

যখন মানুষের লাং বা ফুসফুস যথেষ্ট পরিমাণ বাতাস টানতে পারে না, তখন শরীরে বাতাসের অভাব দেখা দেয়। আর একেই আমরা অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়া বুঝি। শিশুরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত্ম হতে পারে। আর শীতকালে ঠাণ্ডাজনিত অ্যালার্জির কারণে অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে বেশি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে অ্যাজমা বা হাঁপানি রোগটি বাড়ছেই।

গ্রিক ভাষায় অ্যাজমা শব্দের অর্থ হলো হাঁপ ধরা অথবা হাঁ করে শ্বাস টানা। গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস যে কোনো ধরনের শ্বাসকষ্টকে হাঁপানি নাম দিয়েছিলেন। অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট এমন একটা রোগ যার নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। আবার যার অ্যাজমা আছে সে কখনো এ রোগ থেকে একেবারে ভালো হবে না কিন্তু নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। অ্যাজমাকে বলা হয় এমন একটা রোগ যার নিয়ন্ত্রণই একমাত্র চিকিৎসা। অ্যাজমার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। উন্নত দেশ বলুন আর উন্নয়নশীল দেশই বলুন সব স্থানেই অ্যাজমা বেড়েই চলেছে। ৩০০ মিলিয়ন মানুষ বর্তমানে সারা বিশ্বে এ রোগে ভুগছে। ২০২৫ সালের মধ্যে আরো ১০০ মিলিয়ন মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কম বয়সের ছেলেদের মাঝে এ রোগ বেশি দেখা যায়। আর প্রাপ্ত বয়সের রোগীদের মাঝে মহিলারাই বেশি আক্রান্ত হয়। অ্যাজমা রোগ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে স্কুল, কলেজ, বা কর্মক্ষেত্রে স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয়। প্রায়ই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, অনেক সময় মৃত্যুও হতে পারে।

অ্যাজমা বা হাঁপানি রোগীর শ্বাসনালি অতিরিক্ত সংবেদনশীল। এর ফলে কোনো উত্তেজক যেমন ঘরে ধুলা, সিগারেটের ধোঁয়া, ঘরের ঝুল, ঠাণ্ডা লাগা, ফুলের রেণু বা পশু-পাখির সংস্পর্শে আসা ইত্যাদিতে হঠাৎ করে শ্বাসনালি সংকুচিত করে প্রচণ্ড  শ্বাসকষ্টের সৃষ্টি করতে পারে। রোগীর শ্বাসনালির পথ স্বাভাবিক অবস্থার থেকে সরু হয়ে যায়, ফলে ফুসফুসে বাতাস প্রবেশের পথে বাধার সৃষ্টি হয়। ফলে বুকের মধ্যে শোঁ শোঁ শব্দ হয়, শ্বাস নিতে প্রচণ্ড কষ্ট হয়, কাশি হয়, বুকে ভার হয়ে চেপে আসে। এ আক্রমণ মৃদু আকারে দেখা দিলে সামান্য ওষুধ বা ওষুধ ছাড়াই ভালো হয়ে যেতে পারে, আবার এটা মারাত্মক আকার ধারণ করে রোগীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। সঠিক চিকিৎসা হলে এ ধরনের মৃত্যু ৯০% রোধ করা সম্ভব। এ ছাড়া রোগীর শ্বাসনালিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ হয়ে থাকে। একই পরিবেশে একজনের অ্যাজমা অ্যাটাক হচ্ছে কিন্তু অন্য জনের হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ ওই আবহাওয়ায় এমন কিছু জিনিস আছে, যার অ্যাজমা অ্যাটাক হলো সে ওই জিনিসের প্রতি সংবেদনশীল। ওইসব জিনিসকে বলা হয় অ্যাজমা ট্রিগার বা অ্যালার্জেন। অ্যাজমা অ্যাটাকে ট্রিগার বা অ্যালার্জেনগুলো মোটামুটি নিম্নরূপ-
১. ধুলোবালি ২. ফুলের রেণু ৩. পোকামাকড় ৪. ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রম ৫. কিছু ওষুধ (যেমন এসপিরিন) ৬. আবেগ (দুঃখের, ভয়ের কিংবা আনন্দের কারণে হতে পারে) ৭. ধূমপান ৮. পোষা প্রাণী ৯. ঠাণ্ডা এবং ভাইরাস ১০. পশু-পাখির লোম ইত্যাদি।
শ্বাসনালিতে রেসপেরিটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস আক্রমণ করলে অ্যাজমা হতে পারে। এ ছাড়া যৌন কার্যক্রম কারো ক্ষেত্রে অ্যাজমা অ্যাটাক করতে পারে। এসব অ্যালার্জেন একেকজনের বেলায় একেক রকম হতে পারে। কারো একটা, দুটা কারো পাঁচটা-সাতটাও থাকতে পারে। সুতরাং অ্যাজমা অ্যাটাক থেকে বাঁচার জন্য অবশ্যই ধরন অনুযায়ী এগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। যেসব কারণে হাঁপানি সৃষ্টি হয়, তার ওপর ভিত্তি করে অ্যাজমাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়-

অ্যালার্জি বা বাইরের কারণে অ্যাজমা / হাঁপানি

এর ফলে কোনো উত্তেজক যেমন ঘরের ধুলা, ধুলাবালি, ফুলের গন্ধ, নানা ধরনের খাদ্যদ্রব্য, ছত্রাক, সিগারেটের ধোঁয়া, ঘরের ঝুল ঝাড়া, ঠাণ্ডা লাগা, ফুলের রেণু বা পশু-পাখির সংস্পর্শে আসা ইত্যাদিতে হঠাৎ করে শ্বাসনালি সংকুচিত করে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টের সৃষ্টি করতে পারে। জন্ম থেকেই এদের হাঁপানি হওয়ার প্রবণতা থাকে। অনেক সময় এসব রোগীর অ্যালার্জির অন্যান্য উপসর্গও থাকতে পারে। যেমন অ্যালার্জিক রাইনাইটিজ, অ্যাকজিমা ইত্যাদি। জীবনের প্রথম দিকে এ ধরনের হাঁপানি হয়ে থাকে।

স্প্যাজমোটিক বা ভেতরগত কারণে অ্যাজমা / হাঁপানি

এ ধরনের রোগীদের অ্যালার্জির কোনো ইতিহাস থাকে না। জীবনের শেষ দিকে অর্থাৎ অধিক বয়সে এরূপ হাঁপানি হয়ে থাকে।
লক্ষণ: শ্বাসকষ্ট, বুকে সাঁই সাঁই আওয়াজ, বুকে চাপবোধ হওয়া, কাশি উঠতে থাকে। কোনো কোনো সময় কাশি একমাত্র লক্ষণ হতে পারে। প্রায় সময়ই রাতে, ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রমের সময় হয়। তবে যে কোনো সময়ই অ্যাজমা অ্যাটাক হতে পারে।
চিকিৎসা : হাঁপানির তীব্র আক্রমণ হলে রোগীকে সোজা করে বসান, শান্ত করুন  এবং আশ্বস্ত করুন। সলবিউটামল জাতীয় ওষুধের ইনহেলার ৫ বার ঝাঁকিয়ে নিন, ৫ চাপ ওষুধ নিন, প্রতি চাপ নেয়ার পর ৫ সেকেন্ড দম ধরে রাখুন, ৫ মিনিট পরে আবার একইভাবে ইনহেলার ব্যবহার করুন। কোনো পরিবর্তন না হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। অ্যালার্জিজনিত হাঁপানির ক্ষেত্রে যেসব জিনিসে রোগীর শ্বাসকষ্ট বৃদ্ধি পায় তা পরিহার করা উচিত।

অ্যাজমা প্রতিরোধের উপায় / হাঁপানি প্রতিরোধের উপায়

১. অ্যালার্জিকারক বস্তু এড়িয়ে চলা। যেমন- ধুলো, বালি, ঘরের ঝুল, ধোঁয়া, ঝাঁঝাল গন্ধ ইত্যাদি থেকে দূরে থাকা।
২. ঘরবাড়ি ধুলো-বালিমুক্ত রাখার চেষ্টা করা। এ জন্য দৈনিক অন্তত একবার ঘরের মেঝে, আসবাবপত্র, ভেজা কাপড় দিয়ে মুছতে হবে। অথবা ভ্যাকিউম ক্লিনার ব্যবহার করা।
৩. ঘরে কার্পেট না রাখা।
৪. বালিশ, তোশক, ম্যাট্রেসে তুলা ব্যবহার না করে স্পঞ্জ ব্যবহার করা।
৫. শীতকালে যথাসম্ভব গরম পানিতে অজু-গোসল করা।
৬. ধূমপান না করা।
৭. যেসব খাবারে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তা পরিহার করে চলা।
৮. ঠাণ্ডা খাবার, আইসক্রিম ইত্যাদি না খাওয়া।
৯. মানসিক চাপ, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্ত্মাকে ইতিবাচক মনোভাবে মানিয়ে চলা। কিংবা মানসিক চাপের কারণকে এড়িয়ে চলা।
১০. পেশাগত কারণে অ্যাজমা হলে চেষ্টা করতে হবে স্থান বা পেশা পরিবর্তনের।
১১. পরিশ্রম বা খেলাধুলার কারণে শ্বাসকষ্ট বাড়লে চেষ্টা করতে হবে পরিশ্রমের কাজ পরিহার করা।
১২. সব সময় ইতিবাচক চিন্তা করা। ইতিবাচক মন আপনাকে ভালো থাকতে সাহায্য করবে।
১৩. পরাগরেণু পরিহারে সকাল-সন্ধ্যা বাগান এলাকায় বা শস্য-ক্ষেতের কাছে না যাওয়া।
১৪. পরাগরেণু এলাকা থেকে বাসায় ফিরে মাথার চুল ও কাপড় ধুয়ে ফেলা।
১৫. কুকুর-বিড়াল বাগান থেকে পরাগরেণু বহন করতে পারে। এ জন্য নিয়মিত কুকুর-বিড়ালকে গোসল করানো প্রয়োজন।

অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে করণীয় / হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে করণীয়

১. ধূমপান করবেন না। ধূমপায়ী ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলুন।
২. শয়নকক্ষে খুব বেশি মালামাল রাখবেন না।
৩. ঘরের সম্ভাব্য সব কিছু ঢেকে রাখবেন, যাতে ধুলোবালি কম ওড়ে।
৪. টিভি, মশারিস্ট্যান্ড, সিলিং, পাখার ওপর জমে থাকা ধুলোবালি সপ্তাহে একবার অন্য কাউকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে নিন।
৫. শোকেস বা বুক সেলফে রাখা পুরনো খাতা, ফাইল, বইপত্র অন্য কাউকে দিয়ে ঝেড়ে নিন।
৬. বাস, মোটর গাড়ি বা যানবাহনের ধোঁয়া থেকে দূরে থাকবেন।
৭. উগ্র সুগন্ধি ব্যবহার করবেন না। তীব্র দুর্গন্ধ, ঝাঁঝাল গন্ধ থেকে দূরে থাকুন।
৮. বাসায় হাঁস-মুরগি, বিড়াল, কুকুর, পোষা প্রাণী যেন না থাকে এবং এগুলোর সঙ্গে মেলামেশা করবেন না।
৯. বাড়িতে ফুলের গাছ লাগাবেন না।
১০. ঘাসের ওপর বসে থাকা পরিহার করুন। নিজে ঘাস বা গাছ কাটবেন না।
১১. শীতে গরম পানি দিয়ে গোসল করবেন এবং মাফলার ব্যবহার করবেন।
১২. শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করুন। জোরে শ্বাস টানুন, প্রায় ১৫ সেকেন্ড শ্বাস ধরে রাখুন। দুই ঠোঁট শীষ দেয়ার ভঙিতে আনুন এবং ধীরে ধীরে মুখ দিয়ে শ্বাস ফেলুন প্রতিদিন সকাল ও বিকালে ১০ মিনিট করে মুক্ত পরিবেশে।
১৩. সব সময় ভয় ও চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করুন এবং কখনো হতাশাগ্রস্থ হয়ে ভেঙে পড়বেন না।
১৪. ছোট বাচ্চারা লোশম পুতুল নিয়ে খেলা করবে না।
১৫. ঘর ঝাড়ু দেবেন না। ঘর ঝড়ু দিতে হলে মাস্ক, তোয়ালে বা গামছা দিয়ে নাক বেঁধে নেবেন।
১৬. কাশি শক্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শমতো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাবেন।
১৭. ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি/পানীয় কম খাবেন। হালকা গরম পানি পান করবেন।
১৮. অ্যারোসল বা মশার কয়েল ঘরে ব্যবহার করবেন না।
১৯. বিছানার চাদর বা বালিশের কভার পাঁচ দিন পরপর ধুয়ে ব্যবহার করবেন।
২০. মশারি সপ্তাহে একবার ধুয়ে ব্যবহার করবেন।

Leave a Reply